• বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

দিন পরিবর্তনে নতুন স্বপ্ন দেখায় সর্বজনীন পেনশন

  • প্রকাশিত ১৮ মার্চ ২০২৪

মো. বাবুল আক্তার:

বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা এবং তাদের নিরাপত্তাহীনতা। এ কারণেই গত বছরের ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থা। শুরুতে চারটি আলাদা স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু আগামী অর্থ বছর (২০২৪-২৫) থেকে একটি বাড়িয়ে এটিকে পাঁচটি স্কিম করা হচ্ছে। পেনশন স্কিমের মাধ্যমে দেশের ১০ কোটির অধিক ষাটোর্ধ মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে বলে মনে করে সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ এবং ২০৪১ সালে তাদের সংখ্যা হবে ৩ কোটি ১০ লাখ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে ২০২৩ সালে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থা (স্কিম) চালু করে সরকার। এর মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বসবাসরত ১৮ বছরের বেশি বয়সী যেকোনো বাংলাদেশি এখন সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার আওতায় আসতে পারবেন। শুরুতে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যোগ দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা এ চারটি আলাদা স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়। প্রবাস স্কিমটি শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। প্রগতি স্কিম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য। সুরক্ষা স্কিম রিকশাচালক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য। আর সমতা স্কিম নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। তবে এ বছরের ১ জুলাইয়ের পরে নিয়োগ পাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তারা বিদ্যমান ব্যবস্থার মতো আর অবসরোত্তর পেনশন সুবিধা পাবেন না। সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার আওতায় তাদের জন্য ‘প্রত্যয়’ নামক একটি নতুন স্কিম চালু করতে যাচ্ছে সরকার। যা আগামী জুলাই থেকে করা হবে। একজন পেনশনধারী ব্যক্তি ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর পেনশন পাওয়া শুরু করবেন।

জুলাই থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান আসছে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আনতে গত বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) অর্থ বিভাগের প্রবিধান শাখা একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, জুলাই থেকে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার অধীনে ‘প্রত্যয়’ নামক একটি নতুন স্কিম চালু করা হবে। যারা বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, তারাও কমপক্ষে ১০ বছর চাকরি থাকা সাপেক্ষে এ স্কিমে যোগ দিতে পারবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়ে।

নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান একজন চাকরিজীবীর মূল বেতনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা- যেটি বেতনের চেয়ে কম হবে- তা কেটে নেওয়ার পাশাপাশি একই পরিমাণ অর্থ ওই চাকরিজীবীর অ্যাকাউন্টে জমা রাখবে। চাকরিজীবী চাইলে তার চাঁদার হার বাড়িয়ে তা ব্যক্তিগতভাবে পরিশোধ করতে পারবেন।

কোনো চাকরিজীবী কমপক্ষে টানা ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার পর মাসিক পেনশন পাবেন। আর যদি তিনি ১০ বছরের কম সময়ের জন্য চাঁদা দেন, তাহলে লভ্যাংশসহ এককালীন অর্থ ফেরত পাবেন।একজন চাকরিজীবী ৪২ বছর ধরে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিলে তিনি প্রতি মাসে তিন লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা হারে পেনশন পাবেন। আর কেউ যদি ১০ বছরের জন্য চাঁদা দেন, তাহলে তার মাসিক পেনশন হবে ১৫ হাজার ৩০২ টাকা।

বর্তমানে স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং পেনশন ব্যবস্থা না থাকা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোয় কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড রয়েছে। এ তহবিলে কর্মীরা তাদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ এবং কোম্পানি ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ জমা রাখে।

এ তহবিল থেকে কর্মীরা অবসরকালীন সুবিধা পান। এছাড়া চাকরিজীবী দুই মাসের মূল বেতনের সমান একটি বার্ষিক আনুতোষিক ভাতাও পান যা মূলত সরকারি বাজেট থেকে দেওয়া হয়। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এ সিদ্ধান্ত একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে সরকারি চাকরিতে যারা নিয়োগ পাবেন, তাদের জন্যও একই ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, করপোরেশন বা আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করেন, তাদের সঙ্গে সরকারি চাকরিজীবীদের সুবিধার ব্যবধান পূরণ করতে সরকারি কর্মচারীদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

অর্থ বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, এ সিদ্ধান্তের দুটি সুবিধা রয়েছে পেনশন বাবদ সরকারের ব্যয় কম হবে এবং পেনশন তহবিলের আকার বাড়বে। তিনি পেনশন অথরিটি বোর্ডে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব এবং স্কিমের সহজলভ্যতা বাড়াতে জেলাপর্যায়ে পেনশন অফিস গঠনের প্রস্তাব দেন।

সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যাডেট কলেজ; করপোরেশন; বিডা, বেজাসহ সব ধরনের কর্তৃপক্ষ; সরকারি ব্যাংক; শিক্ষা বোর্ড; রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি; ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ সব ধরনের ইনস্টিটিউট; বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন বোর্ড; পেট্রোবাংলা, ওয়াসার মতো প্রতিষ্ঠান; টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনসহ সব ধরনের কমিশন, সব ধরনের কাউন্সিল, সব ধরনের বন্দর সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হলো।

এদিকে গত বছর চালু হওয়া প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা, ও প্রবাস স্কিমে গত ২ মার্চ পর্যন্ত ২১ হাজার ৯৫ জন নিবন্ধন করেছেন। তহবিলে মোট চাঁদা জমা হয়েছে ৩২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। তবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণে সন্তুষ্ট নন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। এ অবস্থায় পেনশন স্কিমকে আরও আকর্ষণীয় করতে কাজ করছে কর্তৃপক্ষ।

সরকারি কর্মচারীদের পরিসংখ্যান-২০২২ অনুসারে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোতে প্রায় ১৪ লাখ কর্মরত জনবলসহ মোট ১৯ লাখ পদ রয়েছে। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং করপোরেশনগুলোতে মোট চার লাখ ১৫ হাজার ৩৪১টি পদের বিপরীতে কর্মী রয়েছে দুই লাখ ৫৭ হাজার ৫২২ জন। চলতি অর্থবছরে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধাবাবদ ৩২ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

পেনশনের ব্যবস্থাপনা যেভাবে হবে :

পেনশন-ব্যবস্থা পরিচালনা ও বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা অর্থ বিভাগের আওতাধীন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে গেলে পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। প্রথমেই একটি পাতা আসবে, সেখানে লেখা থাকবে, ‘প্রত্যয়ন করছি যে আমি সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নই। সর্বজনীন পেনশন স্কিমবহির্ভূত কোনো ধরনের সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা গ্রহণ করি না। আমি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় কোনো ধরনের ভাতা গ্রহণ করি না।’

এরপর ‘আমি সম্মত আছি’ অংশে ক্লিক করলে দ্বিতীয় পাতায় গিয়ে নিবন্ধনপ্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। এখানে আবেদনকারীকে প্রবাস, সমতা, সুরক্ষা বা প্রগতিÑ এই চার স্কিমের মধ্য থেকে প্রযোজ্য স্কিম বাছাই করতে হবে। একই সঙ্গে ১০, ১৩ বা ১৭ সংখ্যার এনআইডি নম্বর, জন্ম তারিখ, মোবাইল নম্বর, ইমেইল আইডি লিখে দিতে হবে। এরপর পাতার নিচের দিকে থাকা ক্যাপচা লিখে পরের পাতায় যেতে হবে। এরপর ব্যক্তিগত তথ্যের পাতা আসবে। ব্যক্তির এনআইডি অনুযায়ী এনআইডি নম্বর, ছবি, আবেদনকারীর বাংলা ও ইংরেজি নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে (যেহেতু আগের পাতায় এ তথ্যগুলো দেওয়া আছে)।

তবে এখানে আবেদনকারীর বার্ষিক আয় লিখতে হবে এবং পেশা, নিজ বিভাগ, জেলা ও উপজেলার নাম নির্বাচন করতে হবে। পেশা বাছাইয়ের ঘরে শিক্ষক, বেসরকারি চাকরিজীবী, ছোট ব্যবসায়ী, ব্যবসা, দিনমজুর, আইনজীবী, সাংবাদিক ইত্যাদি পেশার উল্লেখ আছে। সেখান থেকে নিজের পেশা নির্বাচন করতে হবে। সব লেখা সম্পন্ন হলে পরের ‘স্কিম তথ্য’ এর পাতায় যেতে হবে।

স্কিম তথ্যের পাতায় এলে সেখান থেকে মাসিক চাঁদার পরিমাণ ও চাঁদা পরিশোধের ধরন বাছাই করতে হবে। চাঁদা পরিশোধের ধরনের মধ্যে মাসিক, ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক এ তিন অপশন রয়েছে। এরপর ব্যাংক তথ্যের ধাপে যেতে হবে।

ব্যাংক তথ্যের পাতায় আবেদনকারীর ব্যাংক হিসাবের নাম ও নম্বর, হিসাবের ধরন (সঞ্চয়ী অথবা চলতি), রাউটিং নম্বর, ব্যাংকের নাম ও ব্যাংকের শাখার নাম লিখতে হবে। এরপর পরবর্তী নমিনি তথ্যের পাতায় নমিনির জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও জন্ম তারিখ দিয়ে নমিনিকে যুক্ত করতে হবে। এ সময় নমিনির মোবাইল নম্বর, নমিনির সঙ্গে সম্পর্ক, নমিনির প্রাপ্যতার হারের (একাধিক নমিনি হলে) তথ্য দিয়ে সর্ব শেষ ‘সম্পূর্ণ ফরম’ ধাপে যেতে হবে।

এটিই নিবন্ধনের শেষ ধাপ। এ ধাপে আগে পূরণ করা ব্যক্তিগত তথ্য, স্কিম তথ্য, ব্যাংক তথ্য ও নমিনি তথ্য দেখানো হবে। সেখানে কোনো ভুল থাকলে আবার শুরু থেকে গিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে। আর সব তথ্য ঠিক থাকলে তাতে সম্মতি দিয়ে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এ সময় চাইলে সম্পূর্ণ আবেদনটি ডাউনলোডও করতে পারবেন আবেদনকারী।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads